ঢাকা 5:42 am, Wednesday, 18 June 2025

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভেঙে কেন দুই ভাগ করা হচ্ছে, ব্যাখ্যা দিলো সরকার

  • Reporter Name
  • Update Time : 10:38:40 pm, Tuesday, 13 May 2025
  • 15 Time View

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজস্ব খাতে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার ঘোষণা করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে এর পরিবর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করা হচ্ছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হলো রাজস্ব নীতি নির্ধারণ এবং প্রশাসনের কাজ পৃথক করা, যাতে দক্ষতা বাড়ানো যায়, স্বার্থের সংঘাত কমানো যায় এবং দেশের করভিত্তি সম্প্রসারিত করা যায়।

আজ মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। তুলনামূলকভাবে, বৈশ্বিক গড় ১৬.৬ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় এটি ১১.৬ শতাংশ। জনগণের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমানভাবে এ বিষয়ে ঐক্যমত গড়ে উঠেছে যে একটি প্রতিষ্ঠানকে কর নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের উভয় দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়—এ ধরনের ব্যবস্থা স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে এবং অদক্ষতা বাড়ায়। বহু বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন যে, রাজস্ব আদায়কে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ন্যায্যতা, প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা উপেক্ষিত হয়েছে।

এনবিআরের দীর্ঘদিনের কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে:
স্বার্থের সংঘাত:
একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ফলে কর নীতিতে দুর্বলতা ও ব্যাপক অনিয়ম দেখা দিয়েছে। বর্তমানে কর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জবাবদিহির কোনো কাঠামো নেই এবং তারা প্রায়ই কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কর আদায়কারীরা ফাঁকিবাজদের সহায়তা করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে।

কর আহরণকারীর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য কোনো নিরপেক্ষ পদ্ধতি নেই এবং তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে না নির্দিষ্ট কর্মক্ষমতা নির্দেশকের ওপর।
অদক্ষ রাজস্ব সংগ্রহ:
দ্বৈত দায়িত্ব পালনের কারণে নীতিনির্ধারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গঠনে মনোযোগ বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে করের আওতা সংকুচিত থেকেছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভাবনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে।

দুর্বল শাসনব্যবস্থা:
এনবিআরে আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি, বিনিয়োগ সহায়তায় দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বল শাসনের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে।
প্রশাসনে দ্বৈততা:
বর্তমান কাঠামোতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব একইসঙ্গে এনবিআরেরও প্রধান হওয়ায় বিভ্রান্তি ও অদক্ষতা দেখা দিয়েছে, যা কার্যকর কর নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।

কর্মীদের হতাশা ও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা:
এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ কর ও শুল্ক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে, কারণ অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে তারা উপেক্ষিত হতে পারেন।

সংস্কার কীভাবে সহায়ক হবে:
নতুন কাঠামো এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তুলবে।
দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন:
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ বাস্তবায়ন, অডিট ও পরিচালন তদারকি করবে। এই বিভাজন নিশ্চিত করবে যে, কর নির্ধারণকারী কর্মকর্তারা আর কর সংগ্রহের দায়িত্বে নেই, ফলে অপব্যবহারের সুযোগ কমবে।

দক্ষতা ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন:
প্রতিটি বিভাগ তার নিজস্ব কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারবে, বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়বে, স্বার্থের সংঘাত কমবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততা উন্নত হবে।
করভিত্তি সম্প্রসারণ ও প্রত্যক্ষ কর জোরদার:
এই সংস্কার করের আওতা বাড়াবে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং উপযুক্ত পদে দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহকে আরও শক্তিশালী করবে।

উন্নয়নমুখী নীতিমালা:
একটি স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণ ইউনিট তথ্য-নির্ভর, ভবিষ্যতমুখী কৌশল প্রণয়ন করতে পারবে, যা শুধু স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি:
স্বচ্ছ, পূর্বানুমেয় নীতি এবং পেশাদার কর প্রশাসন বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে এবং বেসরকারি খাতের অভিযোগ হ্রাস পাবে।
এই কাঠামোগত সংস্কার কেবল একটি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস নয়—এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা একটি ন্যায্য, দক্ষ ও সক্ষম কর ব্যবস্থা গঠনের দিকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যা শক্তিশালী নীতিনির্ধারণ ও দুর্নীতিমুক্ত কর প্রশাসন বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা পূরণ এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র:বাসস

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

পাঠক প্রিয়

রাজশাহীতে করোনা পরীক্ষার একমাত্র ভরসা রামেক-এর পিসিআর ল্যাব

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভেঙে কেন দুই ভাগ করা হচ্ছে, ব্যাখ্যা দিলো সরকার

Update Time : 10:38:40 pm, Tuesday, 13 May 2025

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজস্ব খাতে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার ঘোষণা করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে এর পরিবর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করা হচ্ছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হলো রাজস্ব নীতি নির্ধারণ এবং প্রশাসনের কাজ পৃথক করা, যাতে দক্ষতা বাড়ানো যায়, স্বার্থের সংঘাত কমানো যায় এবং দেশের করভিত্তি সম্প্রসারিত করা যায়।

আজ মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। তুলনামূলকভাবে, বৈশ্বিক গড় ১৬.৬ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় এটি ১১.৬ শতাংশ। জনগণের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমানভাবে এ বিষয়ে ঐক্যমত গড়ে উঠেছে যে একটি প্রতিষ্ঠানকে কর নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের উভয় দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়—এ ধরনের ব্যবস্থা স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে এবং অদক্ষতা বাড়ায়। বহু বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন যে, রাজস্ব আদায়কে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ন্যায্যতা, প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা উপেক্ষিত হয়েছে।

এনবিআরের দীর্ঘদিনের কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে:
স্বার্থের সংঘাত:
একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ফলে কর নীতিতে দুর্বলতা ও ব্যাপক অনিয়ম দেখা দিয়েছে। বর্তমানে কর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জবাবদিহির কোনো কাঠামো নেই এবং তারা প্রায়ই কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কর আদায়কারীরা ফাঁকিবাজদের সহায়তা করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে।

কর আহরণকারীর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য কোনো নিরপেক্ষ পদ্ধতি নেই এবং তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে না নির্দিষ্ট কর্মক্ষমতা নির্দেশকের ওপর।
অদক্ষ রাজস্ব সংগ্রহ:
দ্বৈত দায়িত্ব পালনের কারণে নীতিনির্ধারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গঠনে মনোযোগ বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে করের আওতা সংকুচিত থেকেছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভাবনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে।

দুর্বল শাসনব্যবস্থা:
এনবিআরে আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি, বিনিয়োগ সহায়তায় দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বল শাসনের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে।
প্রশাসনে দ্বৈততা:
বর্তমান কাঠামোতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব একইসঙ্গে এনবিআরেরও প্রধান হওয়ায় বিভ্রান্তি ও অদক্ষতা দেখা দিয়েছে, যা কার্যকর কর নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।

কর্মীদের হতাশা ও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা:
এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ কর ও শুল্ক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে, কারণ অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে তারা উপেক্ষিত হতে পারেন।

সংস্কার কীভাবে সহায়ক হবে:
নতুন কাঠামো এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তুলবে।
দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন:
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ বাস্তবায়ন, অডিট ও পরিচালন তদারকি করবে। এই বিভাজন নিশ্চিত করবে যে, কর নির্ধারণকারী কর্মকর্তারা আর কর সংগ্রহের দায়িত্বে নেই, ফলে অপব্যবহারের সুযোগ কমবে।

দক্ষতা ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন:
প্রতিটি বিভাগ তার নিজস্ব কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারবে, বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়বে, স্বার্থের সংঘাত কমবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততা উন্নত হবে।
করভিত্তি সম্প্রসারণ ও প্রত্যক্ষ কর জোরদার:
এই সংস্কার করের আওতা বাড়াবে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং উপযুক্ত পদে দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহকে আরও শক্তিশালী করবে।

উন্নয়নমুখী নীতিমালা:
একটি স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণ ইউনিট তথ্য-নির্ভর, ভবিষ্যতমুখী কৌশল প্রণয়ন করতে পারবে, যা শুধু স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি:
স্বচ্ছ, পূর্বানুমেয় নীতি এবং পেশাদার কর প্রশাসন বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে এবং বেসরকারি খাতের অভিযোগ হ্রাস পাবে।
এই কাঠামোগত সংস্কার কেবল একটি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস নয়—এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা একটি ন্যায্য, দক্ষ ও সক্ষম কর ব্যবস্থা গঠনের দিকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যা শক্তিশালী নীতিনির্ধারণ ও দুর্নীতিমুক্ত কর প্রশাসন বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা পূরণ এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র:বাসস